ADS বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন: [email protected]

বিনয় – বাদল – দীনেশ জীবনী – বিনয় বসু – বাদল গুপ্ত – দীনেশ গুপ্ত – Benoy Badal Dinesh Biography in Bengali

Benoy Badal Dinesh Biography in Bengali
Benoy Badal Dinesh Biography in Bengali

বিনয় – বাদল – দীনেশ জীবনী: Bengaliportal.com আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছে Benoy Badal Dinesh Biography in Bengali. আপনারা যারা বিনয় – বাদল – দীনেশ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী বিনয় – বাদল – দীনেশ জীবনী টি পড়ুন ও জ্ঞানভাণ্ডার বৃদ্ধি করুন।

বিনয় বসু কে ছিলেন? Who is Benoy Basu?

বিনয় কৃষ্ণ বসু (১১ই সেপ্টেম্বর ১৯০৮ – ১৩ই ডিসেম্বর ১৯৩০), যিনি বিনয় বসু নামে বেশি পরিচিত, ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন অন্যতম বাঙালি ব্যক্তিত্ব এবং অগ্নিযুগের বিপ্লবী।

বাদল গুপ্ত কে ছিলেন? Who is Badal Gupta?

বাদল গুপ্ত (১৯১২ – ১৯৩০) ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন ব্যক্তিত্ব ও অগ্নিযুগের শহীদ বাঙালি বিপ্লবী। বাদল গুপ্তের আসল নাম সুধীর গুপ্ত। তার জন্ম ঢাকার বিক্রমপুর এলাকার পুর্ব শিমুলিয়া গ্রামে, যা বর্তমানে বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জ জেলার অন্তর্গত। বানারিপাড়া স্কুলে পড়ার সময়ে সেখানকার শিক্ষক নিকুঞ্জ সেন বাদলকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেন। বাদল বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সে স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে যোগ দেন।

দীনেশ গুপ্ত কে ছিলেন? Who is Dinesh Gupta?

দীনেশচন্দ্র গুপ্ত (৬ই ডিসেম্বর ১৯১১ – ৭ই জুলাই ১৯৩১) ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী একজন স্বনামধন্য বাঙালি বিপ্লবী। তিনি দীনেশ গুপ্ত নামেই সমধিক পরিচিত। তিনি ঢাকা ও মেদিনীপুরে বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। মেদিনীপুরে তার সংগঠন পরপর তিন জন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে হত্যা করেছিল। ১৯৩০ সালের ৮ ডিসেম্বর বিপ্লবী বিনয় বসুর নেতৃত্বে তিনি ও বাদল গুপ্ত কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং (বর্তমান মহাকরণ) ভবনে অভিযান চালিয়ে, বিভাগের অত্যাচারী ইন্সপেক্টর জেনারেল সিম্পসনকে হত্যা করেন। রাইটার্স বিল্ডিং-এর অলিন্দে পুলিশের সঙ্গে তাদের খণ্ডযুদ্ধে বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ ইউরোপীয় কর্মচারী গুরুতরভাবে আহতও হন। এরপর তারা আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। অপর দুই বিপ্লবী আত্মহত্যায় সমর্থ হলেও মৃতপ্রায় দীনেশকে পুলিশ বাঁচিয়ে তুলতে সক্ষম হয়। বিচারে তার ফাঁসির আদেশ হয়। মৃত্যুর পূর্বে জেলে বসে তিনি কয়েকটি চিঠি লিখেছিলেন। এই চিঠিগুলি ভারতের বিপ্লবী ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দলিল এবং সাহিত্যিক বিচারেও অত্যন্ত মূল্যবান। স্বাধীনতার পর তার ও তার অপর দুই সহবিপ্লবীর সম্মানার্থে কলকাতার প্রসিদ্ধ ডালহৌসি স্কোয়ারের নাম বিনয়-বাদল-দীনেশ বাগ (সংক্ষেপে বিবাদীবাগ) রাখা হয়।

বিনয় বসু জীবনী – Benoy Basu Biography in Bengali

নামবিনয় বসু
জন্ম11 সেপ্টেম্বর 1908
পিতারেবতীমোহন বসু
মাতা
জন্মস্থানরোহিতভোগ, বিক্রমপুর, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত
জাতীয়তাভারতীয়
পেশাভারতীয় বিপ্লবী
মৃত্যু13 ডিসেম্বর 1930 (বয়স 22)

বাদল গুপ্ত জীবনী – Badal Gupta Biography in Bengali

নামবাদল গুপ্ত
জন্ম1912
পিতা
মাতা
জন্মস্থানপূর্ব শিমুলিয়া, বিক্রমপুর, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত
(বর্তমানে বাংলাদেশে)
জাতীয়তাভারতীয়
পেশাভারতীয় বিপ্লবী
মৃত্যু8 ডিসেম্বর 1930 (বয়স 17-18)

দীনেশ গুপ্ত জীবনী – Dinesh Gupta Biography in Bengali

নামদীনেশ গুপ্ত
জন্ম6 ডিসেম্বর 1911
পিতাসতীশচন্দ্র গুপ্ত
মাতাবিনোদিনী দেবী
জন্মস্থানজোশোলং, বিক্রমপুর, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত
(বর্তমানে বাংলাদেশে)
জাতীয়তাভারতীয়
পেশাভারতীয় বিপ্লবী
মৃত্যু7 জুলাই 1931 (বয়স 19)

bengaliportal

 

বিনয় – বাদল – দীনেশ জীবনী – বিনয় বসু – বাদল গুপ্ত – দীনেশ গুপ্ত – Benoy Badal Dinesh Biography in Bengali

বিনয় – বাদল – দীনেশ সময়টা ১৯৩০ খ্রিঃ ৮ ই ডিসেম্বর। শীতের আড়ষ্টতা কাটিয়ে জেগে উঠেছে কলকাতা নগরী। কর্মব্যস্ততার মধ্যে গতানুগতিক ধারায় প্রবাহিত হয়ে চলেছে মহানগরীর জমজমাট জীবন। বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ তিনটি যুবক পুরোপুরি সাহেবী পোশাকে সজ্জিত, এসে দাঁড়ালেন রাইটার্স বিল্ডিং – এর বড় গেটের সামনে। কোনরকম ইতস্ততঃ না করে তিনজনই সিঁড়ি ভেঙ্গে দোতলায় উঠে গেলেন। দেখা করতে চাইলেন কারা বিভাগের অত্যাচারী ইনসপেক্টর জেনারেল কর্নেল সিম্পসন সাহেবের সঙ্গে।

অনুমতি কিংবা বাধা আসার আগেই তিনজনই দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে পড়লেন। সিম্পসন তখন নিজের টেবিলে বসে মনোযোগ দিয়ে জরুরী ফাইল দেখছিলেন। সাড়া পেয়ে মুখ তুলে তাকালেন। কিন্তু কিছু বুঝবার আগেই তিন যুবকের হাতের পিস্তল গর্জে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে মেঝেয় লুটিয়ে পড়লেন সিম্পসন। সিসার তপ্ত বুলেটে ঝাঝরা হয়ে যাওয়া সিম্পসনের দেহ সঙ্গে সঙ্গেই নিথর হয়ে গেল। এই তিন যুবকই হলেন বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত ওরফে সুধীর গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্ত। বিপ্লবী বাংলার তিন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ।

আরও পড়ুন: ফা-হিয়েন জীবনী

আরও পড়ুন: চার্লি চ্যাপলিন জীবনী

আরও পড়ুন: হেলেন কেলার জীবনী

আরও পড়ুন: সক্রেটিস জীবনী

আরও পড়ুন: ভীমরাও রামজি আম্বেদকর জীবনী

এই তিন বিপ্লবীই বিনয় – বাদল – দীনেশ নামে দেশবাসীর কাছে পরিচিত। গুলির শব্দ শুনে আলোড়ন পড়ে গেল রাইটার্সের অভ্যন্তরে। ছুটে এলেন রক্ষীর দল, পুলিশ বিভাগের অন্য অফিসাররা গুলি চালালেন তিন যুবককে লক্ষ্য করে। কিন্তু সবই লক্ষভ্রষ্ট হল, ততক্ষণে বারান্দা পার হয়ে গুলি চালাতে চালাতে ওরা তিনজন পাসপোর্ট অফিসের সামনে চলে এসেছেন। উভয় পক্ষেই চলতে লাগল গুলি বিনিময়। ইতিমধ্যে জরুরী বার্তা পৌঁছে গেছে পুলিশের হেডকোয়ার্টার লালবাজারে।

দূরত্ব ঘটনা স্থল থেকে মাত্র মিনিট দুইয়ের পথ। ছুটে এল পুলিশবাহিনী। ক্রমাগত গুলি চালিয়ে তিন যুবকই আশ্রয় নিয়েছিলেন একটি ঘরে। পুলিশ বাহিনী উপস্থিত হবার আগেই তিন জনেরই গুলি ফুরিয়ে গেল। এবারে ধরা পড়া ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু বিপ্লবীরা তো ধরা পড়ে না। তাদের যে আদর্শ হয় মারো নয় মরো। মারবার মত অস্ত্রের রসদ শেষ। এবারে যে পথ খোলা তা হল মরবার পথ। তার জন্যও প্রস্তুত হয়ে এসেছিলেন বিনয় – বাদল – দীনেশ। দলনেতা বিনয়, তাঁর নির্দেশে তিনজনই পকেট থেকে বার করলেন উগ্র বিষ, অবলীলায় মুখে পুরে দিলেন।

বিনয়ের মাথায় গুলি লেগে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। তিনি আচ্ছন্নের মত বসে পড়লেন টেবিলের ওপরে। দীনেশও আহত, পটাসিয়াম মুখে দেবার সঙ্গে সঙ্গেই সংজ্ঞা হারিয়ে ফেললেন। বাদল প্রাণ হারিয়েছিলেন আগেই। ততক্ষণে বীরদর্পে পুলিশ বাহিনী ঢুকে পড়ল ঘরে। তারা দেখল, একজন যুবকের প্রাণহীন দেহ মেঝেয় পড়ে আছে। তার পাশেই একজন সংজ্ঞাহীন। অপর যুবক টেবিলে মাথা রেখে বসে আছেন আচ্ছন্নের মতো। পুলিশ অফিসারের প্রশ্নের উত্তরে তিনি নাম বললেন বিনয় বসু।

তিন জনকেই হাসপাতালে পাঠানো হলো। বাদল হাসপাতালে পৌঁছবার আগেই প্রাণ হারিয়েছিলেন। বিনয় ও দীনেশকে নিয়ে পড়লেন ডাক্তারের দল। শেষ পর্যন্ত গুলির আঘাত ও পটাসিয়ামের আক্রমণ সত্ত্বেও বেঁচে গেলেন দীনেশ। বিনয়ও বেঁচে গেলেন, তবে মাথার আঘাতের জন্য হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রইলেন। পুলিশ অনেক চেষ্টা করেও এই দুই বিপ্লবীর কাছ থেকে কোন কথা বার করতে ব্যর্থ হল।

সুস্থ হয়ে উঠছেন বুঝতে পেরে চিকিৎসাধীন বিনয় মাথার ব্যান্ডেজ আলগা করে ক্ষতস্থানে আঙুলের খোঁচা দিয়ে ঘা বিষাক্ত করে তুললেন। এভাবে গ্রেপ্তার হবার পাঁচ দিনের মধ্যেই তিনি নিশ্চিত মৃত্যু সম্ভব করে তুললেন। জানতেন, সুস্থ হয়ে উঠলে পুলিশী নির্যাতনের ফলে মন্ত্রগুপ্তি মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা। সব কথা জানার জন্য পুলিশ মরিয়া হয়ে উঠবে। তাই নিজেই নিজের ব্যবস্থা করে নিলেন।

১৯৩০ খ্রিঃ ১৩ ই ডিসেম্বর বিপ্লবীবীর বিনয় বসুর জীবন দীপ নির্বাপিত হল। ইংরাজের ডাক্তার বাহিনী বহু চেষ্টায় মৃতকল্প দীনেশকে বাঁচিয়ে তুলল। সরকার বহু চেষ্টা করল, কিন্তু তাঁর কাছ থেকে কোন স্বীকারোক্তি আদায় করতে পারল না। ফলে শুরু হলো তথাকথিত বিচার এবং যথারীতি দীনেশের ফাসির আদেশ হল।

বর্তমানে রাইটার্স বিল্ডিংস এর সামনের লালদীঘি ও বাগানের নামকরণ হয়েছে বিনয় – বাদল – দীনেশ বাগ, সংক্ষেপে বি – বা – দী বাগ। কলকাতা রাইটার্স বিল্ডিংসে বীর ত্রৈয়ীর পুলিশের সঙ্গে যে যুদ্ধ হয়েছিল ১৯৩০ খ্রিঃ ৮ ই ডিসেম্বর, ইতিহাসের পাতায় তাই অলিন্দ যুদ্ধ নামে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। এই অলিন্দযুদ্ধের বীর সেনানীদের নামেই নামাঙ্কিত হয়েছে রাইটার্সের সম্মুখস্থ বাগান ৷ কিন্তু কারা এই বিনয় – বাদল – দীনেশ ? বিনয় বসুই ছিলেন অলিন্দ যুদ্ধের বীরত্রৈয়ীর নেতা।

১৯০৮ খ্রিঃ ১১ ই সেপ্টেম্বর ঢাকা জেলার রাইতভোর গ্রামে বিনয়ের জন্ম। তাঁর পিতার নাম রেবতীমোহন বসু। কৈশোরেই বিনয় ঢাকার বিপ্লবী নেতা হেমচন্দ্র ঘোষের সংস্পর্শে আসেন। বাংলায় গুপ্তসমিতি আন্দোলনের যুগে দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা নামে গড়ে উঠেছিল বহু দল উপদল। হেমচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে ঢাকায় গড়ে উঠেছিল মুক্তিসঙ্ঘ। সঙ্ঘের মুখপাত্র হিসেবে প্রকাশিত হত বেণু পত্রিকা। হেমচন্দ্রের প্রভাবে বিনয় মুক্তিসঙ্ঘের সঙ্গে যুক্ত হলেন। বেণু গ্রুপের সঙ্গেও সংযোগ স্থাপিত হল তাঁর। ১৯২৮ খ্রিঃ গঠিত হয় বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দল। সেই সময় বেণুগ্রুপের অন্যান্যদের সঙ্গে বিনয়ও বি.ভি দলকে দৃঢ়ভাবে সংগঠিত করেন।

স্কুলের পড়া শেষ করে বিনয় ডাক্তারি পড়ার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা মিডকোর্ট মেডিক্যাল স্কুলে। সেইসময়েই তিনি ২৯ শে আগষ্ট ১৯৩০ খ্রিঃ দলের নির্দেশে ঢাকার কুখ্যাত পুলিশ অফিসার লোম্যানকে হত্যা করে আত্মগোপন করেন। এরপরই কারাধ্যক্ষ সিম্পসন ও স্বরাষ্ট্রসচিব মারকে হত্যা করার দায়িত্ব তাকে দেওয়া হয়। দলনেতার নির্দেশ অনুযায়ী তিনি দীনেশ গুপ্ত ও বাদল গুপ্তকে নিয়ে ১৯৩০ খ্রিঃ ৮ ই ডিসেম্বর রাইটার্স বিল্ডিংস এ গিয়ে সিম্পসনকে হত্যা করেন।

অলিন্দযুদ্ধের অন্যতম সৈনিক বাদল গুপ্তও ছিলেন ঢাকার পূর্ব শিমুলিয়া অঞ্চলের ছেলে। তার জন্ম ১৯১২ খ্রিঃ। পিতার নাম অবনীন্দ্রনাথ গুপ্ত। তাঁর অপর নাম সুধীর গুপ্ত। তিনিও ছিলেন গুপ্ত বিপ্লবী দল বি.ভির সদস্য। দলনেতার নির্দেশেই তিনি আই.জি.কর্নেল সিম্পসন হত্যার আয়োজনে যুক্ত হন। বিনয় ও বাদল এই দুই জন অলিন্দযুদ্ধের সময়েই গুলি ফুরিয়ে গেলে সায়ানাইড বিষ খেয়ে ও মাথায় গুলি করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। বিনয় সঙ্গে সঙ্গেই প্রাণ হারান। বাদল গ্রেপ্তার হবার পাঁচ দিন পরে মারা যান। মৃতকল্প দীনেশকে বহু চেষ্টায় বাঁচিয়ে তোলা হয়।

পরে বিচারে তাঁর প্রাণদন্ডাদেশ দীনেশ গুপ্তর জন্ম ১৯১১ খ্রিঃ ৬ ই ডিসেম্বর ঢাকা জেলার যশোলং গ্রামে। তার পিতার নাম সতীশচন্দ্র গুপ্ত। কৈশোরেই গুপ্ত সমিতিতে যোগ দিয়ে প্রথমে ঢাকায় ও পরে মেদিনীপুরে বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলেন। মেদিনীপুরের সংগঠন এমনই সুদৃঢ় হয়ে উঠেছিল যে সেখানে বিপ্লবীরা পর পর তিনজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে হত্যা করতে সমর্থ হয় ৷ ১৯৩০ খ্রিঃ ৮ ই ডিসেম্বর বিনয় বসুর নেতৃত্বে দীনেশ ও বাদল কলকাতা রাইটার্স বিল্ডিংস আক্রমণ করে আই.জি সিম্পসনকে নিহত এবং কয়েকজন উচ্চ পদস্থ শ্বেতাঙ্গ কর্মচারীকে আহত করেন।

আরও পড়ুন: ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংস জীবনী

আরও পড়ুন: বাঘা যতীন জীবনী

আরও পড়ুন: নেপোলিয়ন বোনাপার্ট জীবনী

আরও পড়ুন: কার্ল মার্ক্স জীবনী

আরও পড়ুন: গুরু গোবিন্দ সিংহ জীবনী

মৃত্যুদন্ডাজ্ঞা প্রাপ্ত কয়েদীদের সেলে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে অবস্থানরত দীনেশ। মাত্র বিশ বছর বয়সের জীবনে তিনি যে সংগঠনী শক্তির পরিচয় দিয়েছিলেন, অগ্নিযুগের ইতিহাসে তার নজির খুব কমই আছে। মৃত্যু ছিল যেন তাঁর পায়ের ভৃত্য। হাসতে হাসতে তাকে ব্যঙ্গ করেছেন পদে পদে। মৃত্যু সম্পর্কে তিনি ছিলেন নির্লিপ্ত ও উদাসীন। তার কারা জীবনের দিনগুলিতে এই সত্য বেশি করে প্রকাশিত হয়েছিল। খেতে খুব ভালবাসতেন দীনেশ। খাওয়ার ব্যাপারে তাঁর কোন বাছবিচার ছিল না।

যে কোনরকম খাদ্যবস্তু হলেই হল। নির্বিকারে তা গলাধঃকরণ করতেন। তখনো তিনি সিম্পসন হত্যা – অভিযানে আসেননি। দলের সাংগঠনিক কাজে ব্যস্ত রয়েছেন গ্রামে। সেই সময়ে বিপ্লবীদের বাধ্যতামূলকভাবে একটা কাজ করতে হত। সৈন্যব্যারাকে, নিজেকে উপযুক্তভাবে গড়ে তুলবার জন্য সকালে বা বিকালে মার্চ করা যেমন বাধ্যতামূলক, তেমনি বিপ্লবীদেরও প্রতিদিন মার্চ করে পাড়ি দিয়ে যেতে হত গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। একদিন দলনেতা জ্যোতিষ জোয়ারদারের নেতৃত্বে সকলে মার্চ করে এগিয়ে চলেছেন বিক্রমপুর গ্রামের পথ ধরে। একটানা হেঁটে এসে সন্ধ্যা নাগাদ গ্রামের একট। বাজারে যাত্রার বিরতি হল। এবারে হল ফেরার পালা। সকলেরই খিদে। কিছু পেটে না দিলেই নয়। দলবেঁধে একটা মিষ্টির দোকানে গিয়ে জুটলেন। গ্রামের বাজারের দোকান। মিষ্টি মজুদ থাকে সব সময়েই। সাজো বাসি সব খাবারই শেষ হয়ে গেল। পেট ভরেই খেলেন সবাই তৃপ্তি করে।

এবারে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার শুরু হবে ফিরতি পথে যাত্রা। দীনেশ কিন্তু তখনো ছোঁক ছোঁক করছেন। আরো কিছু খেলে মন্দ হত না। কি খাওয়া যায় ? আছে নাকি কিছু ? উকিঝুঁকি মেরে দেখলেন দোকানের কোণে এককড়াই চিনির সিরা রয়েছে। হাসি মুখে দোকানীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ওটাই দিন — চালান করে দিই। দোকানী তো কথা শুনে আঁতকে উঠলেন। সর্বনাশ। ওটা যে দিন কয়েকের বাসি, যেমনি টক তেমনি দুর্গন্ধ ওতে। ও জিনিস মুখে তুললে আর দেখতে হবে না— এখুনি ডাক্তার ডাকতে হবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। দীনেশ খেতে চেয়েছেন যখন খাবেনই।

দোকানী বাধা দেবার আগেই দুহাতে কড়াইটা তুলে নিলেন মুখের কাছে। এক চুমুকেই কড়াই ফাঁকা। অসুস্থ কিন্তু হন নি দীনেশ। যেমন খেতে ভালবাসতেন তেমনি হজম করার ক্ষমতা ছিল দাপুটে। ১৯৩০ খ্রিঃ সেই স্মরণীয় ৮ ই ডিসেম্বর রাইটার্সে অভিযান করবার আগেই দীনেশ আর বাদল আস্তানা নিয়েছিলেন পার্ক স্ট্রীটের একটা গোপন জায়গায় ৷ সেখান থেকেই যাবার কথা সেই দুঃসাহসিক অভিযানে। মেটিয়াবুরুজে রাজেন গুহর বাড়ি। বিনয় সেখান থেকে এসে মিলিত হবেন এই দুজনের সঙ্গে। অ্যাকসন স্কোয়াডের নিকুঞ্জ সেনের সঙ্গে আগের দিনই দীনেশ কড়ার করে নিয়েছেন, অভিযানে যাবার আগে পেটভরে খাওয়াতে হবে।

মেনুটা ঠিক করে দেবেন দীনেশ নিজেই। ঘন্টা দুয়েক পরেই তিন সৈনিক ঝাপিয়ে পড়বেন নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে। তার আগে তিনজনকেই কথামত ভরপেট খাইয়েছিলেন নিকুঞ্জ সেন। বেশি খেয়েছিলেন অবশ্য দীনেশ আর বাদল। লক্ষ করবার বিষয় হল সেদিনের বিপ্লবীদের মৃত্যুভয়হীন মানসিকতার কথা। মৃত্যুবরণ করবার সংকল্প নিয়েই ঢুকতে হবে শত্রুর দুর্গে, তার আগে খাওয়া নিয়ে এমন হারজিত খেলা — অতটুকু ভয়ভাবনা নেই কারো মনে — ঈশ্বরের কী আশ্চর্য সৃষ্টি এই দেশপ্রেমীর দল। দীনেশের খাওয়ার শেষ ঘটনা ঘটেছিল আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের ভেতরে। বিচারের রায় তখন বেরিয়েছে।

দীনেশ কনডেম্ড সেলে মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গুণছেন। নিজেও তিনি জানেন সে কথা। তার মধ্যে কিন্তু ভাবান্তর নেই। চেহারাও টসকায়নি এক বিন্দু। জীবন নিয়ে যেন মজার খেলায় মেতে আছেন। সহকর্মী সুনীল সেনগুপ্তরও দিন কাটছিল একই জেলে একনম্বর ওয়ার্ডে।দীনেশ ওয়ার্ডারের হাতে হঠাৎই সেদিন চিঠি পাঠালেন তাকে। ছোট্ট চিঠিতে লিখে জানিয়েছেন – না কোন আত্মীয় – বন্ধুর কথা বা মৃত্যু সম্বন্ধে কোন তত্ত্ব কথাও নয়। লিখেছেন, ‘ একটু লুচি মাংস খাওয়াতে পারেন ? ’ দুদিন পরেই যাঁর ফাসির দিন নির্দিষ্ট তার কাছ থেকে এমন চিঠি পেলে বুক তো ফেটে যাবার কথা।

কিন্তু বিপ্লবীদের তো ভাবাবেগে ভেঙ্গে পড়লে চলে না। তাঁদের জীবন কঠিন কঠোর। কিন্তু নীরবে চোখ মুছলেন সুনীল সেনগুপ্ত। জেলের ভেতরে লুচি মাংস কি করে জোগাড় করবেন তিনি ? এ যে অসম্ভব এক ব্যাপার। তিনি নিজেও যে একজন বন্দী। এই জীবনে সাধ থাকলেও তা পূরণের সাধ্য তো নেই। কিন্তু দীনেশ যে খেতে চেয়েছেন। প্রাণপণ চেষ্টা করেও যে নিজেকে ধরে রাখতে পারছেন না। ভেতরের তোলাপড়া ফুটে উঠছে মুখে চোখে ৷ জেলের অন্য আসামীদের মধ্যে ছিল মতি নামে একজন খুনী আসামী ৷ বিশ বছরের কারাদন্ড ভোগ করছে সে। সুনীলের ভাবান্তর তার চোখ এড়াল না।

এগিয়ে এসে জানতে চাইল, স্বদেশীবাবুকে আজ এমন মনমরা দেখাচ্ছে কেন ? খুনী আসামী হলেও বন্দিজীবনের বন্ধু মতি। তার সহানুভূতির স্পর্শে নিজেকে আর ধরে রাখা সম্ভব হল না। সব কথা খুলে জানালেন। শুনে কেমন গুম হয়ে গেল অমন ডাকসাইটে বেপরোয়া মানুষটা। খানিক্ষণ কি চিন্তা করে একসময় ধরা গলায় জানাল, জেল ক্যান্টিনের লোকজনের ওপর তার খানিকটা দাপট আছে, সে সেখান থেকে লুচির ব্যবস্থা করে দিতে পারবে। তবে মাংসের কোন সুরাহা করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। মতি কথা দিল, যে করে হোক সে লুচির ব্যবস্থা করে দেবে। কিন্তু মাংস, তার কি হবে ? ভেবে কুল কিনারা করতে পারেন না সুনীল।

দুপুর পার হল, বিকেল এল। এই সময়ে বন্দিদের কিছুক্ষণের জন্য জেলের নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরস্পরের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ ও কথাবার্তার একটা সুযোগ পাওয়া যায়। অবশ্য মৃত্যুদন্ডে দন্ডীত আসামীরা এই নিয়মের বাইরে। কনডেম্ড সেল ছেড়ে তারা বাইরে বেরতে পারে না। মন তোলপাড়, মাথায় চিন্তার বোঝা – মাংস পাওয়া যায় কোথায়—। এই অবস্থায় একসময় সুনীল এসে দাঁড়ালেন বাইরের সেই নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে। হঠাৎ চোখ পড়ে পাঁচিলের ধারে ঘুরে বেড়াচ্ছে কয়েকটা মুরগী। জেলেরই পোষা এগুলো।

সঙ্গে সঙ্গে মাথায় এসে গেল, যদি কোনক্রমে ওখান থেকে একটাকে ধরে নেওয়া যায় তাহলে কি মতিকে ধরে ক্যান্টিন থেকে রান্নার ব্যবস্থা হবে না ? মুহূর্তে মনস্থির করে ফেললেন সুনীল। একটা চাদর দিয়ে সমস্ত শরীর জড়িয়ে নিলেন। তারপর পায়ে পায়ে এগোতে শুরু করলেন পাখিগুলোর দিকে। সন্তর্পণে। দীনেশ মাংস খেতে চেয়েছেন। দুদিন পরেই তাঁর ফাসী। ওটুকু ব্যবস্থা যদি করতে না পারেন তাহলে সারাজীবনেও যে তিনি শান্তি পাবেন না। চলতে চলতে থমকে দাঁড়াতে হল।

ইউরোপীয়ান ওয়ার্ডের ব্যানার্জীবাবু পেছন থেকে ডেকেছেন। ভদ্রলোক কারাদন্ড ভোগ করছিলেন অন্য কি কারণে। রাজনীতির সঙ্গে সেই অপরাধের সংশ্রব ছিল না বলেই সম্ভবতঃ তাঁকে রাখা হয়েছিল ইউরোপীয়ান ওয়ার্ডে। সেখানে অন্য কয়েদীদের তুলনায় সুযোগসুবিধা কিছুটা বেশি। আইন – কানুনের কড়াকড়িও এতটা নেই। ব্যানার্জীবাবু সুনীলের অদ্ভুত বেশবাস দেখে কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলেন, এভাবে তিনি কোথায় চলেছেন ? সুনীল বলেই ফেললেন ব্যানার্জীবাবুকে মৃত্যুপথযাত্রী দীনেশের অন্তিম ইচ্ছার কথা ! সেই ইচ্ছাপূরণের চেষ্টাতেই যে তিনি মুরগী ধরার জন্য ওৎ পেতে অগ্রসর হচ্ছিলেন নিঃসঙ্কোচে তা – ও জানালেন।

শুনে কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রইলেন ব্যানার্জীবাবু। শেষে সুনীলকে আশ্বস্ত করে জানালেন, তিনি যে করে হোক ইউরোপীয়ান ওয়ার্ড থেকে কিছু মাংস সুনীলের কাছে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করবেন। সে – রাতে সবার উপেক্ষিত খুনী আসামী মতির জোগাড় করে দেওয়া লুচি আর ইউরোপীয়ান ওয়ার্ডের ব্যানার্জীবাবুর জোগাড় করা কিছু মাংস যথাসময়ে সুনীল পাঠিয়ে দিতে পেরেছিলেন দীনেশের সেলে। দীনেশ মাংস – লুচি খেতে চেয়েছিলেন জীবনে শেষবারের মত। কিন্তু জেলের ভেতরে বন্দি জীবনে থেকে এটুকুর বাইরে আর কি করার ছিল সুনীলের। কিংবা মতি বা ব্যানার্জীবাবুর। এগিয়ে এল ১৯৩১ খ্রিঃ ৬ ই জুলাই।

সেদিন ভোররাতে হাসতে হাসতে ফাসীর দড়ি গলায় তুলে নিলেন দীনেশ। বাংলামায়ের দামাল দুলালদের আর একজন প্রেরণার প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়ে বিদায় নিলেন পৃথিবীর মাটি থেকে। এই সম্পর্কে ৮ ই জুলাই তারিখে কাগজে যে বিবরণ ছাপা হয়েছিল তা হলঃ “ বিশ বছরের বালক দীনেশ ফাসি – কাণ্ঠে প্রাণ দিল। বালক যেমন নূতন খেলনা ব্যগ্র হাত বাড়াইয়া গ্রহণ করিতে লালায়িত হয়, অসীম রহস্যময় মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াইতে তাঁহার তেমনি সাধ হইয়াছিল। মাতা – পিতা, স্নেহশীলা ভ্রাতৃজায়া সকলকে সে এই বলিয়া প্রবোধ দিতে চেষ্টা করিয়াছে, মৃত্যু ভয়ঙ্কর নহে, সে মরণমালা। মরণমালা গলায় পরিয়া মরণজয়ী জীবনের জয়োল্লাসে চলিয়া গেল ৷

আরও পড়ুন: সত্যেন্দ্রনাথ বসু জীবনী

আরও পড়ুন: কানাইলাল দত্ত জীবনী

আরও পড়ুন: অনন্ত সিং জীবনী

আরও পড়ুন: মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী জীবনী

আরও পড়ুন: প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার জীবনী

দীনেশ বাঁচিল না। তাঁহাকে মৃত্যুর গ্রাস হইতে রক্ষা করা গেল না। খেদক্ষিণ্ণ নৈরাশ্যের দীর্ঘশ্বাস একটা জাতির পঞ্জর – পিঞ্জর কাঁপাইয়া শূন্যে মিলাইয়া গেল। কম্পিত অধরোন্ঠে কি কথা মৌন রহিয়া গেল, বোঝা গেল না। কেহ কি বুঝিবে ? ” ফাসির অপেক্ষায় কারান্তরালে থেকে দীনেশ কয়েকটি চিঠি লেখেন তাঁর নিকট আত্মীয়দের কাছে। বিপ্লব সাধনায় ত্যাগব্রতীদের হৃদয়ের অপরিমেয় উদারতা এই পত্রগুলিতে পরিস্ফুট হয়েছে। সাহিত্যের বিচারেও এই পত্রগুলি খুবই মূল্যবান। অলিন্দযুদ্ধের এই বীরত্রয়ীর নামেই কলকাতা শহরের লালদিঘি উৎসর্গ করা হয়েছে।

Leave a Reply