ADS বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন: [email protected]

রোনাল্ড রস জীবনী – Ronald Ross Biography in Bengali

Ronald Ross Biography in Bengali
Ronald Ross Biography in Bengali
Rate this post

রোনাল্ড রস জীবনী: Bengaliportal.com আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছে Ronald Ross Biography in Bengali. আপনারা যারা রোনাল্ড রস সম্পর্কে জানতে আগ্রহী রোনাল্ড রস এর জীবনী টি পড়ুন ও জ্ঞানভাণ্ডার বৃদ্ধি করুন।

রোনাল্ড রস কে ছিলেন? Who is Ronald Ross?

স্যার রোনাল্ড রস (১৩ই মে, ১৮৫৭ – ১৬ই সেপ্টেম্বর, ১৯৩২) একজন স্কটিশ (ব্রিটিশ) চিকিৎসক ও ব্যাকটেরিয়াবিজ্ঞানী ছিলেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা সনদ লাভের পরে তিনি ভারতীয় চিকিৎসাব্যবস্থাতে যোগদান করেন। তিনি তৃতীয় ইঙ্গ-বর্মী যুদ্ধে (১৮৮৫) অংশগ্রহণ করেন। এরপর তিনি ১৮৮৮ ও ১৮৮৯ সালে আবার লন্ডনে গিয়ে ব্যাকটেরিয়াবিজ্ঞানে পড়াশোনা শেষ করে ভারতে ফেরত আসেন। সেখানে তিনি স্যার প্যাট্রিক ১৮৯৭ সালে অ্যানোফিলিস জাতীয় মশার পৌষ্টিকনালীতে ম্যালেরিয়া রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু প্লাসমোডিয়াম আবিষ্কার করেন।

তিনি সুস্থ ও সংক্রমিত পাখিদেরকে অধ্যয়ন করে প্লাসমোডিয়াম জীবাণুর সমগ্র জীবনচক্র সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করেন। তিনি দেখান যে মশার লালাগ্রন্থিতে প্লাসমোডিয়াম জীবাণু থাকে এবং মশার কামড়ের মাধ্যমে এটি অন্য পোষকের দেহে সংক্রমিত হয়। তাঁর এই কাজের উপর ভিত্তি করে অ্যানোফিলিস মশার বংশবিস্তার রোধের মাধ্যমে ম্যালেরিয়া রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। যার ফলে বিশ্বজুড়ে বহু কোটি মানুষের প্রাণরক্ষা পেয়েছে। রস ১৯০২ সালে ম্যালেরিয়া রোগের উপরে গবেষণার জন্য চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

রোনাল্ড রস জীবনী – Ronald Ross Biography in Bengali

নামরোনাল্ড রস
জন্ম13 মে 1857
পিতাক্যাম্পবেল ক্লে গ্রান্ট রস
মাতামাটিল্ডা শার্লট এল্ডারটন
জন্মস্থানআলমোড়া, উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ, ভারত
জাতীয়তাব্রিটিশ
পেশাচিকিৎসক ও ব্যাকটেরিয়া বিজ্ঞানী
মৃত্যু16 সেপ্টেম্বর 1932 (বয়স 75)

bengaliportal

 

রোনাল্ড রস এর জন্ম: Ronald Ross’s Birthday

রোনাল্ড রস 13 মে 1857 জন্মগ্রহণ করেন।

ম্যাল শব্দের অর্থ খারাপ বা কু, আর আরিয়া মানে বাতাস। দুই শব্দ মিলিয়ে হয় ম্যালেরিয়া। বাংলায় যা হল খারাপ বাতাস বা কু – বাতাস ৷ প্রাচীন গ্রীক চিকিৎসকরা মনে করতেন শরীরে দুষিত বাতাস বা কু – বাতাস ঢুকলেই এই রোগ হয়। ইংরাজরা এই রোগকে বলত মার্শ ফিভার। ইংরাজি মার্শ শব্দের অর্থ জলাভূমি। তার মানে জলাভূমি থেকে যে রোগের উৎপত্তি তাই হল মার্শ ফিভার।

উৎপত্তি যেখানেই হোক কি করে এই রোগ শরীরে প্রবেশ করে, বংশ বিস্তার করে, সেই সুদূর প্রাচীন কাল থেকেই চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করে কোন সমাধানে পৌঁছতে পারেন নি। আজ থেকে ১৬০০ বছর আগে এক জার্মান কৃষিবিজ্ঞানী পালাদিয়াস সাফ প্রথম বলেছিলেন মশার কামড়েই ম্যালেরিয়া রোগের সংক্রমণ ঘটে থাকে।

তিনি আরও বলেছিলেন, বদ্ধ জলেই মশা ডিম পাড়ে, সেই জল পেটে গেলে ম্যালেরিয়ার আক্রমণ অবধারিত। পালাদিয়াস সতর্ক করে বলেছিলেন, নালা – নর্দমা কেটে জলের বদ্ধদশা না ঘোচাতে পারলে ম্যালেরিয়াও দূর করা যাবে না। একজন গ্রীক বিজ্ঞানী, তার নাম, হেরোডোটাস, ১০০০ বছর আগেই মিশরের লোকেদের দেখেছিলেন মশারি খাটিয়ে ঘুমোতে। মশার আক্রমণ থেকে রেহাই পাবার জন্যই তারা এই ব্যবস্থা অবলম্বন করে ম্যালেরিয়া রোগকে ফাঁকি দিত।

আরও পড়ুন: মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনী

আরও পড়ুন: নসট্রাদামুস জীবনী

আরও পড়ুন: রাজা রামমোহন রায় জীবনী

আরও পড়ুন: বারট্রান্ড রাসেল জীবনী

আরও পড়ুন: রোম্যাঁ রোলাঁ জীবনী

যত যাই হোক, বহু দীর্ঘ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে, চিকিৎসকরা ম্যালেরিয়ার কবল থেকে মানুষকে রক্ষা করতে পারেন নি। বাস্তব অবাস্তব নানা চিকিৎসা দ্বারাও ম্যালেরিয়ার আক্রমণ ঠেকানো সম্ভব হয় নি। শেষ পর্যন্ত ম্যালেরিয়াকে যিনি সার্থকভাবে প্রতিরোধ করতে পেরেছিলেন, তাঁর নাম রোনাল্ড রস। বিজ্ঞানসম্মত উপায়েই তিনি তা করেছিলেন। বিজ্ঞানী রস প্রমাণ করেছিলেন, মশাই ম্যালেরিয়ার জীবাণু বহন করে। কিভাবে মশারা এই রোগজীবাণু ছড়িয়ে দিয়ে রোগের বিস্তার ঘটায়, তিনিই প্রথম আমাদের জানান।

কেবল তাই নয়, যে বিশেষ ধরনের মশা ম্যালেরিয়ার জীবাণুর বাহক, সেই সম্পর্কেও তিনিই প্রথম আলোকপাত করেন। বিজ্ঞানী রস ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের অস্ত্র আমাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, সেই সঙ্গে পোকামাকড় বাহিত হলুদ জ্বর, ঘুমজুর টাইফয়েড ও প্লেগ ইত্যাদি মারাত্মক রোগকে জয় করার উপায়ও আমাদের জানিয়ে দিয়েছিলেন।

চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে বিজ্ঞানী রসের অবদান মানব সভ্যতার এক বিশেষ অধ্যায় ৷ অথচ রস কোনদিনই ভাবেননি যে তিনি বিজ্ঞানী হবেন, নতুন নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে বিশ্ববিজ্ঞানের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করবেন। চিত্রশিল্প, সঙ্গীত, সাহিত্য রচনা এই গন্ডীর মধ্যেই ছিল তাঁর আন্তরিক আনাগোনা। প্রকৃত ইচ্ছা ছিল শিল্পী হবার। অথচ ভাগ্যের এমনই বিচিত্র ব্যবস্থা যে বাবার নির্দেশে ইচ্ছার বিরুদ্ধেই ডাক্তারি পড়া শুরু করেছিলেন।

পাশ করে বেরিয়ে চিকিৎসাকেই করেছিলেন জীবিকার্জনের মাধ্যম। রস ডাক্তার না হলে, মানুষের ইতিহাসে ম্যালেরিয়ার আধিপত্য আরও কতকাল তা বলতে পারে।

রোনাল্ড রস এর পিতামাতা ও জন্মস্থান: Ronald Ross’s Parents And Birth Place

ব্রিটিশ ভারতে ভারতীয়দের মধ্যে প্রথম স্বাধীনতার জাগরণ ঘটিয়েছিল ১৮৫৭ খ্রিঃ সিপাহী যুদ্ধ ৷ এই যুদ্ধের সরকারি ঘোষণার মাত্র তিনদিন আগে তেরোই মে নগাধিরাজ হিমালয়ের কোলে আলমোড়ায় এক সম্ভ্রান্ত স্কট পরিবারে রসের জন্ম। রসের বাবা স্যার ক্যাম্পবেল ক্লে গ্রান্ট রস ছিলেন সেনা বিভাগের উচ্চপদস্থ অফিসার। দশ ভাইবোনের মধ্যে রসই ছিলেন জ্যেষ্ঠ।

রোনাল্ড রস এর শিক্ষাজীবন: Ronald Ross’s Educational Life

বিদুষী মায়ের স্নেহ যত্ন ও শিক্ষায় সাত বছর বয়স পর্যন্ত ভারতেই কেটেছে তার। তারপর শিক্ষালাভের জন্য তাকে ইংলন্ডে পাঠানো হয়। রস তার ছাত্রজীবন থেকেই বাবার মত ছবি আঁকতে, গল্পকবিতা লেখায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। বিজ্ঞানে যে অরুচি ছিল তা নয়। তার মধ্যে প্রাণিবিদ্যার বই বেশি ভাল লাগত। পড়াশুনার চেয়ে নিজের মনে ছবি আঁকার দিকেই ছিল বেশি ঝোক। স্বপ্ন দেখতেন শিল্পী হবার।

এদিকে এক অঙ্ক প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেয়েছিলেন চোদ্দ বছর বয়সেই। ষোল বছর বয়সে অক্সফোর্ডে ভর্তি হন, পরে পড়াশুনা করেন কেমব্রিজে। বাবার জেদে শিল্পী হবার সাধ অপূর্ণই রইল শেষ পর্যন্ত। ভর্তি হতে হল লন্ডনের বার্থোলোমিউ হাসপাতালের মেডিক্যাল স্কুলে। ছয় বছর পরে ডাক্তার হয়ে বেরলেন।

রোনাল্ড রস এর কর্ম জীবন: Ronald Ross’s Work Life

এই সময় ভারত থেকে বাবা চিঠি লিখে জানালেন, রস যাতে অবিলম্বে ভারতীয় সেনা বিভাগে যোগ দেন ৷ রস বাবার প্রস্তাব মাথায় না রেখে এক বেসরকারি জাহাজে সার্জেনের চাকরি নিয়ে আতলান্তিকে ভেসে পড়লেন। ডাক্তার হিসেবে এই সমুদ্রযাত্রার অভিজ্ঞতা রসের জীবনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। চিকিৎসার সূত্রে তিনি জানতে পেরেছিলেন জাহাজীরা কোন রোগের সঙ্গে কিভাবে যুদ্ধ করে। জাহাজে বসেই জাহাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে রস একটি উপন্যাস লিখলেন। তাঁর এই উপন্যাসের নাম Emigrants.

১৮৮১ খ্রিঃ ইংলন্ডে ফিরে এসে রস ভারতীয় চিকিৎসা বিভাগে যোগ দিলেন ৷ সেই বছরই মাদ্রাজে এলেন স্টেশন হাসপাতালের সার্জেন হয়ে। কাজের মধ্যে হল সারা দিনে দু’ঘণ্টা রুগী দেখা। অখন্ড অবসর কাটে বই পড়ে, কবিতা লিখে আর গান গেয়ে। ভারত রসের জন্মভূমি। সেই কারণে অন্তরের একটা টান স্বাভাবিকভাবেই ছিল। সেই আকর্ষণেই ভারতীয় জনজীবনের দুঃখ দারিদ্র্যের প্রতি তার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। বোগশোকে ভোগা মানুষগুলোর প্রতি সহানুভূতি তার এই সময়ের অনেক কবিতায় ভাষা পেয়েছে।

আরও পড়ুন: যীশু খ্রীষ্ট জীবনী

আরও পড়ুন: গুরু নানক জীবনী

আরও পড়ুন: চৈতন্য মহাপ্রভু জীবনী

আরও পড়ুন: স্বামী বিবেকানন্দ জীবনী

আরও পড়ুন: হজরত মুহাম্মদ জীবনী

কিছুদিনের মধ্যেই রস সপ্তদশ পদাতিক বাহিনীর সঙ্গে সমুদ্রকূলবর্তী ভিজিয়ানা গ্রামে চলে আসেন ৷ এই সময় থেকেই ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য রোগ সম্পর্কে তার মধ্যে কৌতূহল জাগ্রত হয়। চিকিৎসা – বিজ্ঞানের ইতিহাস ঘেঁটে পরজীবী জীবাণুদের বিষয়ে নানা মহামারী রোগের সম্পর্কে পড়াশুনা করতে থাকেন। ১৮৮৪ খ্রিঃ কাজের সূত্রে মাদ্রাজ ছেড়ে ব্যাঙ্গালোরে আসেন রস।

পাহাড়ের ওপরে এক সামরিক দুর্গে থাকার ব্যবস্থা। এখানেই মশার কামড়ে অতিষ্ট হয়ে কিছুদিন শয্যাশায়ী থাকতে হয়েছিল তাঁকে। এতদিন যে ভাবনা মনে ছিল, ভাসা ভাসা অনেকটাই কৌতূহল আর বিলাসিতার পর্যায়ে, এবারে তাই রূপান্তরিত হল প্রতিশোধস্পৃহায়। সংকল্প করেন মশাদের রোগজীবাণু ছড়াবার পথ যে করেই হোক বন্ধ করতে হবে।

ব্যাঙ্গালোর থেকে পরের বছর, ১৮৮৫ খ্রিঃ সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যেতে হল আন্দামান। এখানে তাল – নারকেল ঘেরা সবুজ বনানী আর সাগরবেলার সৌন্দর্য তার কবিমনে দোলা তুলল। এখানে বসেই রচিত হয় তার কবিতার বই In exile। আন্দামানের শাক্ত পরিবেশই একদিন রসকে তার নিজের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল। কর্মক্ষেত্রের অনিশ্চয়তার সূত্রেই এই আত্মজিজ্ঞাসা রসকে সজাগ সচেতন করে তুলল। দীর্ঘদিন থেকেই সামরিক বিভাগে অস্থায়ী চিকিৎসকের পদে রয়েছেন।

মাইনেও অতি সামান্য। এইভাবেই কি বাকি জীবনটাও কেটে যাবে ? জীবনের সার্থকতা তাহলে কি হল ? জীবনের দীর্ঘ ব্যাপ্তিতে মানবজাতির জন্য কি তার কিছুই করবার নেই ? একজন চিকিৎসক হিসেবে নানা ভয়ঙ্কর রোগে ভোগা মানুষগুলোর জন্য কিছুই কি তিনি করতে পারেন না ? এই আত্মজিজ্ঞাসাই অদ্ভুত এক অস্থিরতা তৈরি করল রসের অন্তর্জগতে। ওপর মহলে চিঠি লেখালেখি করে ছুটির ব্যবস্থা করলেন, ১৮৮৮ খ্রিঃ ফিরে এলেন ইংলন্ডে।

গভীরভাবে পড়াশুনা শুরু করলেন জীবাণুবিদ্যা নিয়ে। বিজ্ঞানী কখ্ ও পাস্তুরের নানা প্রবন্ধের ওপরে বারবার করে চোখ বোলাতে লাগলেন। ছুটি ফুরোবার আগেই ১৮৮৯ খ্রিঃ রস বিয়ে করলেন রোজা ব্লসামকে। জীবাণু নিয়ে নানা পরীক্ষা – নিরীক্ষা আর কিছু যন্ত্রপাতির সঙ্গে জীবনে সঙ্গী একজন বাড়ল। বিয়ের কিছুদিন পরেই ভারতে ফিরে এলেন। এই সময় তাকে বদলি করা হল ব্রহ্মদেশে। একবছর সস্ত্রীক সেখানে থাকতে হল।

১৮৯৩ খ্রিঃ ফিরে এলেন ব্যাঙ্গালোরে। টানা নয় বছর অস্থায়ীপদে কাজ করার পর সেই বছরই তাঁকে স্থায়ী করা হল। আর্থিক দিকের ভাবনা সুরাহা হতেই ম্যালেরিয়া নিয়ে গবেষণার কাজ আরও গভীরভাবে করবার সুযোগ পেলেন। গবেষণার কাজে মাঝে মাঝেই হতাশা জেগে উঠত। সেই সময়ে সাধ্বী পত্নী রোজা সান্ত্বনা আর আশ্বাস নিয়ে পাশে এসে দাঁড়াতেন। রসের জীবনসাধনার সাফল্যে তাঁর পত্নীর উৎসাহ ও প্রেরণার অবদান অসামান্য।

তাদের পারিবারিক জীবনও ছিল মধুর। দুই কন্যা ও এক পুত্রের ছোট্ট সংসারটিতে শান্তি ও আনন্দের ঘাটতি পড়েনি কোনদিন। গবেষণার নানা ফলাফল নিয়ে প্রবন্ধ লিখে প্রকাশের জন্য নানা জার্নালে পাঠাতেন রস। কিন্তু সব লেখাই যথারীতি ফেরত আসত। এসব ঘটনার প্রতিক্রিয়া রসের মানসিকতাকে দুর্বল করে তুললেও প্রেরণাময়ী স্ত্রী রোজার বল ভরসা তাকে আবার চাঙ্গা করে তুলত। পিতার মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে রুস সপরিবারে ইংলন্ড গেলেন ১৮৯২ খ্রিঃ।

সেই সময় নানা রোগের প্রতিষেধক হিসেবে জনসাধারণকে টিকা দেওয়ার কাজ হচ্ছিল। রসও এই কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়লেন। এই সময়েই তার পরিচয় হয় চিকিৎসক প্যাট্রিক ম্যানসনের সঙ্গে। গ্রীষ্মপ্রধান দেশের নানা রোগ সম্পর্কে তার যবেষ্ট অভিজ্ঞতা। ম্যালেরিয়া বিষয়ে রসের আগ্রহের সন্ধান পেয়ে ম্যানসন তাকে পরামর্শ দিলেন গ্রীষ্মপ্রধান দেশে বসেই এই রোগের পরীক্ষা – নিরীক্ষা করবার জন্য।

কিভাবে এগোতে হবে সেই সম্পর্কেও এক পরিষ্কার ধারণা রস পেয়ে যান ম্যানসনের কাছ থেকে। আর তা হল, সবার আগে মশার জীবনচক্র সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হওয়া। ম্যালেরিয়া রোগের ভাবনা সেই সময় একটা ঘোরের মত চেপে বসেছিল রসের মাথায়। কেবলই হাতড়ে বেড়াচ্ছিলেন, কিন্তু আলোর রেখা কোন দিকেই দেখতে পাচ্ছিলেন না। পরম হিতৈষী ডাঃ ম্যানসনের কাছ থেকে পথের সন্ধান পেয়ে নতুন ভাবে উজ্জীবিত হয়ে উঠলেন তিনি।

দুঃসময় কেটে আসতে আরম্ভ করেছিল রসের জীবনের। এই সময়েই আকস্মিক একটি ঘটনা তাঁকে আশায় আনন্দে উদ্দীপিত করে তুলল। ইংলন্ডের নেটলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ম্যালেরিয়া নিয়ে এক প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করেছিলেন। রস তার জন্মভূমি ভারতের অভিজ্ঞতার আলোকে লিখলেন একটা প্রবন্ধ, যথারীতি জমাও দিলেন।

তথাকথিত কু – বাতাসের ফলেই ম্যালেরিয়ার আক্রমণ ঘটে এই প্রচলিত প্রাচীন ধারণা যে ভ্রান্ত প্রবন্ধে এ বিষয়ে স্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করলেন তিনি। ইতিপূর্বে অনেক প্রবন্ধই পাঠিয়েছিলেন নানা জায়গায়। কিন্তু অনুকূল সাড়া পাননি। এবারে কিন্তু ফলাফল হল অন্যরকম। চুলচেরা বিচারে রসের প্রবন্ধই সবার সেরা বলে বিবেচিত হল।

রস লাভ করলেন পার্কেস স্বর্ণপদক ও নগদ পঁচাত্তর গিনির পুরস্কার। এই ঘটনায় রসের আত্মবিশ্বাস নতুন প্রেরণায় সঞ্জীবিত হয়ে উঠল। গবেষণার প্রয়োজনে ইতিমধ্যে রস নিজেই বানিয়ে নিয়েছেন উচ্চক্ষমতার একটা ছোট্ট অণুবীক্ষণ যন্ত্র। সাহিত্যচর্চা মাথায় উঠেছে, চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণাতেই তাঁর কেটে যেতে লাগল দিন।

১৮৯৫ খ্রিঃ ভারতে ফিরে এলেন রস। ইংল্যান্ড ছেড়ে এলেও ম্যানসনের সঙ্গে কিন্তু তার যোগাযোগ রয়েই গেল। নিজের পরীক্ষা – নিরীক্ষার বিষয় নিয়মিত লিখে জানাতে লাগলেন ম্যানসনকে। প্রতিভার পৃষ্ঠপোষক ম্যানসনও রসকে পাঠাতে লাগলেন তাঁর উপদেশ নির্দেশ। এভাবেই এগিয়ে চলল রসের গবেষণার কাজ। সেকেন্দ্রাবাদের সামরিক হাসপাতাল এবারের কর্মস্থল।

এখানে এক রুগীর রক্ত পরীক্ষা করে এক ধরনের জীবাণুর সন্ধান পেলেন রস। রুগীটি ম্যালেরিয়া রোগাক্রান্ত। রুগীর মশারির ভেতরে মশা ঢুকিয়ে দিয়ে রক্ত খাওয়া পুষ্ট মশাদের ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করেই জীবাণুর সন্ধান পেয়ে যান। এরপর থেকেই বিভিন্ন মশার জীবনধারা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের কাজ শুরু করেন। ক্ষুদে প্রাণীগুলোর জীবনচক্রের প্রতিটি ধাপ গভীরভাবে লক্ষ করে, নানা পরীক্ষার পর রস নিঃসন্দেহ হন, ম্যালেরিয়ার মূলে রয়েছে মশার কামড়।

আরও পড়ুন: দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ জীবনী

আরও পড়ুন: খান আবদুল গফফর খান জীবনী

আরও পড়ুন: ক্ষুদিরাম বসু জীবনী

আরও পড়ুন: অরবিন্দ ঘোষ জীবনী

আরও পড়ুন: বিনয় – বাদল – দীনেশ জীবনী

মশার লার্ভাযুক্ত জল পান করলে কিংবা জলাভূমির কু – বাতাস থেকে যে ম্যালেরিয়া হয় না তা হাতে কলমে প্রমাণ করলেন রস। তিনি জেনে গেছেন, ম্যালেরিয়ার জীবাণুরা পরজীবী। তিন প্রজাতির মশা তাদের বহন করে বেড়ায়। এই মশাদের জীবনচক্রের বত্রিশটি পর্যায়। রস দেখলেন যখন মশা হুল ফোটায় তখন মানুষের শরীরে তার লালারস ঢোকে ও রক্তের সঙ্গে মিশে যায়। সূচের আকারের ম্যালেরিয়ার পরজীবীরা থাকে মশার লালারসে।

সেখান থেকে রক্তে মিশে সরাসরি লোহিত কণিকার মধ্যে ঢুকে বংশ বিস্তার করে। এই সময়েই পরজীবীরা অর্ধচন্দ্রাকারে পুরুষ ও স্ত্রী এই দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এই অবস্থায় যদি কোন মশা মানুষের রক্ত শোষণ করে সেই রক্তের পরজীবীরা মশার পাকস্থলীতে বাসা নেয়। এইখানে অর্ধচক্রাকৃতি পুং ও স্ত্রী পরজীবীরা মিলিত হয়ে যথারীতি বংশ বিস্তার করে। এইসব পরজীবী তখন মশার পাকস্থলী থেকে লালাগ্রন্থিতে ঢুকে যায়।

এই মশার কামড় থেকেই মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়। এইভাবে একই ইতিহাসের পুনরাবর্তন চলতে থাকে আর বিস্তার লাভ করে ম্যালেরিয়া রোগ। গবেষণার এক পর্যায়ে রস লক্ষ করেন, মশার জীবনচক্রের যে বত্রিশটি পর্যায় তার কোনও একটি পর্যায় বিপর্যস্ত হলেই ম্যালেরিয়াবাহী পরজীবীরা আর পূর্ণাঙ্গ হতে পারে না। ফলে ম্যালেরিয়ার বিস্তারও ব্যাহত হয়।

বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে রস ছিলেন একেবারেই এক অনভিজ্ঞ মানুষ। অণুবীক্ষণযন্ত্র নিয়ে পরীক্ষা – নিরীক্ষায় কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা তার ছিল না। নিজের খোলা চোখ আর তীব্র আগ্রহই ছিল তার সহায় ৷ সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল স্ত্রীর সক্রিয় প্রেরণা ও হিতৈষী প্যাট্রিক ম্যানসনের চিঠিতে পাওয়া উপদেশ – নির্দেশ। এই সম্বল নিয়েই বহুবিধ প্রজাতির মশা ঘেঁটে ম্যালেরিয়ার পরজীবীদের বৃত্তান্ত জানতে পেরেছেন তিনি।

এই পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশটি এখনো তার অজানা। কোন প্রজাতির মশা ম্যালেরিয়ার প্রকৃত বাহক এখনও তা জানার বাকি। দিনের পর দিন গভীর গবেষণা ও পর্যবেক্ষণের পর রস সফল হলেন। জানতে পারলেন অ্যানোফিলিস প্রজাতির মশাই ম্যালেরিয়া রোগের প্রকৃত বাহক। ইতিমধ্যে রস একটি খবর পেয়ে উল্লসিত হলেন। ম্যানসন ইংলন্ডের অধীন উপনিবেশ সমূহের স্বাস্থ্যবিষয়ক উপদেষ্টা নির্বাচিত হয়েছেন।

এই খবরে রসের খুশি হবার কারণ হল, গবেষণা যেই পর্যায়ে এসেছে, এবারে তার নিরবচ্ছিন্ন সময় ও খরচপত্রের অর্থের প্রয়োজন তীব্র হয়ে উঠেছিল, ম্যানসনের সহযোগিতায় হয়তো সেসবের একটা সুরাহা হবে। চাকরি বজায় রেখে গবেষণার কাজ চালাতে খুবই অসুবিধা হচ্ছিল। টান ধরছিল প্রয়োজনীয় সময়ে ৷ দ্বিতীয়তঃ মাইনের সামান্য টাকা থেকে সংসারের খরচ বাঁচিয়ে গবেষণার প্রয়োজনে খুব সামান্যই ব্যয় করতে পারছিলেন।

ফলে কাজ বিঘ্নিত হচ্ছিল দফায় দফায়। ম্যানসন যথেষ্ট চেষ্টা করলেন। কিন্তু ভারত সরকারের সামরিক বিভাগ ম্যালেরিয়ার গবেষণার জন্য রসকে বিশেষ ছুটির ব্যবস্থা করে দিতে সম্মত হল না। তবে আশ্বাস একটা পাওয়া গেল। কলকাতায় ট্রপিক্যাল মেডিসিনের গবেষণাগারে বিভিন্ন গ্রীষ্মবাহিত রোগের বিষয়ে গবেষণার অনুমতি পাওয়া গেল। রস এবারে কলকাতায় এসে গবেষণা আরম্ভ করলেন। এখান থেকেই তিনি ইংলন্ডে ম্যানসনের কাছে তাঁর গবেষণার ফলাফল প্রবন্ধাকারে লিখে পাঠাতে লাগলেন।

১৮৯৮ খ্রিঃ জুন মাসে ম্যানসন সেই প্রবন্ধ ইংলন্ডের ব্রিটিশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনে বিশিষ্ট চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীর সমাবেশে পাঠ করলেন। সেদিনের সেই গুণীজন সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন বিশ্বখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী লর্ড লিস্টার। তিনি প্রবন্ধের বৈজ্ঞানিক গভীরতার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন। সম্ভবতঃ ম্যানসনের ইঙ্গিত পেয়ে ১৮৯৯ খ্রিঃ রস সামরিক বিভাগের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ইংলন্ডে ফিরে গেলেন।

সেই সময়ে লিভারপুলে সবে চালু হয়েছে মেডিক্যাল স্কুল। সেখানেই রস অধ্যাপনার চাকরি পেয়ে গেলেন। শুরু হল তাঁর নতুন জীবন। চিকিৎসা বিজ্ঞানী লর্ড লিস্টার সেই সময়ে রয়াল সোসাইটির সভাপতি। তিনি ম্যালেরিয়া সংক্রান্ত রসের গবেষণাকে বিশ্ববিজ্ঞানের এক উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার হিসাবে মতামত ব্যক্ত করলেন।

আরও পড়ুন: সত্যেন্দ্রনাথ বসু জীবনী

আরও পড়ুন: কানাইলাল দত্ত জীবনী

আরও পড়ুন: অনন্ত সিং জীবনী

আরও পড়ুন: মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী জীবনী

আরও পড়ুন: প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার জীবনী

রোনাল্ড রস এর পুরস্কার ও সম্মান: Ronald Ross’s Awards And Honors

১৯০১ খ্রিঃ রস রয়াল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত এর পরই রসের আবিষ্কারের সংবাদ সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানী মহলে ছড়িয়ে পড়ল। মানবেতিহাসে বিশেষ অবদানের জন্য সুইডিশ নোবেল কমিটি ১৯০২ খ্রিস্টাব্দের চিকিৎসাশাস্ত্রের নোবেল দিয়ে রসকে সম্মানিত করেন। এরপর দেশের ও বিদেশের অসংখ্য পুরস্কারও লাভ করেছেন রস।

১৯১১ খ্রিঃ স্যার উপাধি পান। পঞ্চান্ন বছর বয়সে ১৯১২ খ্রিঃ লিভারপুলের মেডিক্যাল স্কুলের অধ্যাপনার কাজ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯২৬ খ্রিঃ ইংলন্ডে রস – অনুরাগীরা গড়ে তুললেন রস ইনসটিটিউট। তিনি হন এই প্রতিষ্ঠানের সর্বময় কর্তা। পৃথিবী থেকে ম্যালেরিয়া চিরতরে দূর করার লক্ষেই প্রতিষ্ঠিত হয় এই প্রতিষ্ঠান।

রোনাল্ড রস এর মৃত্যু: Ronald Ross’s Death

১৯৩২ খ্রিঃ ১৬ ই সেপ্টেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বিজ্ঞানী রসের দেহান্তর ঘটে।

Leave a Reply