ADS বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন: [email protected]

বিপ্লবী বসন্ত কুমার বিশ্বাস জীবনী – Basanta Kumar Biswas Biography in Bengali

Basanta Kumar Biswas Biography in Bengali
Basanta Kumar Biswas Biography in Bengali

বসন্ত কুমার বিশ্বাস জীবনী: Bengaliportal.com আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছে Basanta Kumar Biswas Biography in Bengali. আপনারা যারা বসন্ত কুমার বিশ্বাস সম্পর্কে জানতে আগ্রহী বসন্ত কুমার বিশ্বাস এর জীবনী টি পড়ুন ও জ্ঞানভাণ্ডার বৃদ্ধি করুন।

বসন্ত কুমার বিশ্বাস কে ছিলেন? Who is Basanta Kumar Biswas?

বসন্ত কুমার বিশ্বাস (6 ফেব্রুয়ারি 1895 – 11 মে 1915) ছিলেন একজন ভারতীয় স্বাধীনতাপন্থী কর্মী যিনি যুগান্তর গ্রুপের সাথে জড়িত ছিলেন, যিনি 1912 সালের ডিসেম্বরে ভাইসরয়ের কুচকাওয়াজে বোমা হামলায় ভূমিকা পালন করেছিলেন, যা এই নামে পরিচিত হয়েছিল। দিল্লি-লাহোর ষড়যন্ত্র বাংলা ও সমগ্র দেশের প্রথম দিকের “সন্ত্রাসীদের” নামগুলোর একজন ছিলেন বিশ্বাস। তিনি বোমা তৈরিতে পারদর্শী ছিলেন এবং যুগান্তর নেতা অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং রাশ বিহারী বসুর দ্বারা বিপ্লবী আন্দোলনে দীক্ষিত হন।

বসন্ত কুমার বিশ্বাস জীবনী – Basanta Kumar Biswas Biography in Bengali

নামবসন্ত কুমার বিশ্বাস
জন্ম6 ফেব্রুয়ারি 1895
পিতামতিলাল বিশ্বাস
মাতাকুঞ্জবালা বিশ্বাস
জন্মস্থানপোড়াগাছা, নদিয়া, পশ্চিমবঙ্গ, ব্রিটিশ ভারত
জাতীয়তাভারতীয়
পেশাবিপ্লবী
মৃত্যু11 মে 1915 (বয়স 20)

bengaliportal

 

বসন্ত কুমার বিশ্বাস এর জন্ম: Basanta Kumar Biswas’s Birthday

বসন্ত কুমার বিশ্বাস 6 ফেব্রুয়ারি 1895 জন্মগ্রহণ করেন।

বসন্ত কুমার বিশ্বাস এর পিতামাতা ও জন্মস্থান: Basanta Kumar Biswas’s Parents And Birth Place

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম যুগের এক জ্বলন্ত অগ্নিশিখা বিপ্লবী বসন্তকুমার দাস। সেই সময়ে এই তরুণ কাপিয়ে তুলেছিলেন কৃষ্ণনগর থেকে দেরাদুন – দিল্লী – লাহোর পর্যন্ত। ১৮৯৫ খ্রিঃ ৬ ই ফেব্রুয়ারি নদীয়া জেলার পোড়াগাছা গ্রামে দেশপ্রেমের জ্বলন্ত প্রতীক বসন্তকুমারের জন্ম। তাঁর বাবা মতিলাল বিশ্বাস ছিলেন রেলের একজন সাধারণ কর্মী। সংসারের আর্থিক অবস্থা বিশেষ ভাল ছিল না। সামান্য কিছু জমিজমা ছিল বলে কোন রকমে সংসার চলে যেত।

আরও পড়ুন: রাণী রাসমণি জীবনী

আরও পড়ুন: মেজর ধ্যানচাঁদ জীবনী

আরও পড়ুন: জিম থর্প জীবনী

আরও পড়ুন: জেসি ওয়েন্স জীবনী

আরও পড়ুন: পাভো নুরমি জীবনী

পারিবারিক সূত্রেই বসন্তকুমার ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের উত্তরাধিকার লাভ করেছিলেন। ব্রিটিশ আমলের মধ্যযুগে এদেশে নীলচাষ নিয়ে দেশবাসীর মনে যথেষ্ট ক্ষোভ বিক্ষোভ জমা হয়েছিল। নদীয়া জেলাও এই আবহাওয়ার বাইরে ছিল না। সেই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে বসন্তকুমারের পূর্বপুরুষরা সেই ধূমায়িত ক্ষোভকে দাবানলে পরিণত করেছিলেন। তাঁদের প্রেরণায় ও পরিচালনায় সংগঠিত নীল চাষীরা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েছিল।

বসন্তকুমারের সেই পূর্বপুরুষদের নাম ছিল দিগম্বর আর বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস। বসন্তকুমার যখন মুড়াগাছা হাইস্কুলের ছাত্র তখন সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন ক্ষীরোদচন্দ্র গাঙ্গুলি। তিনি ছিলেন বিপ্লবী — স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন নির্ভীক সৈনিক। – পূর্বপুরুষদের এই গৌরবময় ইতিহাস বসন্ত কুমারের অজানা ছিল না। আর জানতেন মুড়াগাছা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ক্ষীরোদচন্দ্র গাঙ্গুলি। ফলে অল্পদিনের মধ্যেই বসন্তকুমার বিপ্লবমন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠলেন।

বসন্ত কুমার বিশ্বাস এর কর্ম জীবন: Basanta Kumar Biswas’s Work Life

অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সহ কয়েকজন বিপ্লবীর নাম জানতেন বসন্তকুমার। বিশিষ্ট বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর সঙ্গে অমরেন্দ্রর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। রাসবিহারী যখন বাংলার বাইরে গোপনে বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তুলছিলেন সেই সময় অমরেন্দ্রর মাধ্যমেই তিনি বিপ্লবী কর্মধারায় বাংলার তরুণদের জাগিয়ে তুলতেন। এই তরুণরাই ক্রমে বিপ্লবমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে দেশের মুক্তি আন্দোলনের নির্ভীক সৈনিক রূপে গড়ে উঠতেন ৷

অমরেন্দ্রনাথের সঙ্গে যোগাযোগ হল যথাসময়ে। তিনি বসন্তকুমারকে বিপ্লবী রাসবিহারীর কাছে রেঙ্গুনে পাঠান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে যখন আধুনিক কোনও বোমার আবিষ্কার হয়নি সেই সময়েই বাংলার বিপ্লবীরা হাতবোমা তৈরি করতে শিখে গিয়েছিলেন। লোহা দিয়ে তৈরি করা হত একটা ফাপা গোলাকার খোল। তার মধ্যে লোহার টুকরো, পেরেক ইত্যাদির সঙ্গে রাসায়নিক পদার্থ ভরে যে বোমা তৈরি হত তা ছিল যথেষ্ট শক্তিশালী। আরও উন্নত শ্রেণীর বোমা বানাবার কলাকৌশল বিদেশ থেকে শিখে এসেছিলেন বিপ্লবী হেমচন্দ্র দাস ৷

তারপর থেকেই বিপ্লবীদের মধ্যে বোমা তৈরি ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ল। সেই কালে বোমা তৈরিতে বাঙ্গালী বিপ্লবীরাই ছিল দেশের মধ্যে অগ্রণী। বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলনশুরুর অব্যবহিত কালেই ১৯০৬ খ্রিঃ এবং ১৯০৭ খ্রিঃ নদীয়া জেলায় পর পর বিপ্লবীদের দুটো সম্মেলন হল। প্রথমবারে সম্মেলনে সভাপতি ছিলেন বিপ্লবী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ব্যারিষ্টার প্রমথনাথ মিত্র। পি.মিত্র নামেই তিনি সমধিক পরিচিত ছিলেন। বসন্ত কুমারের তখন বালক বয়স। তিনি সেই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।

এই সম্মেলনের কয়েক বছর আগেই বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ বাংলায় গুপ্ত সমিতি গঠনের জন্য যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ওরফে বাঘা যতীনকে বরোদা থেকে নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন। যতীন্দ্রনাথের চেষ্টায় কেবল বাংলায় নয়, সারা দেশেই গোপনে গুপ্তসমিতি গঠনের শজ জোরদার হয়েছিল। বিপ্লবীদের গুপ্ত সমিতি গড়ে উঠেছিল কলকাতায়, ঢাকায়, রাঁচি – দেরাদুন ও কটকে। সুদূর লাহোরেও বিপ্লবীরা সংগঠিত হয়েছিলেন।

দেশের বাইরে প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যে দেশাত্মবোধ ও স্বাধীনতার প্রচার করবার উদ্দেশ্যে আমেরিকার সানফ্রান্সিসকোর শিখদের সদর পার্টি এবং জার্মানিতে বার্লিন কমিটি নামে দুটি সক্রিয় সমিতিও গড়ে উঠেছিল। ভারতে বিপ্লব সংগঠিত করার কাজে প্রবাসের এই দুটি সংস্থার তৎপরতা ছিল অবিশ্বাস্য। ভারতের মুক্তি আন্দোলনের সৈনিকরা যখন এভাবে দেশে বিদেশে গোপন প্রস্তুতি শুরু করেছে, সেই সময়েই বসন্তকুমার এলেন মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসুর সংস্পর্শে। তখন তার বয়স মাত্র পনের বছর।

সময়টা ১৯১০ খ্রিঃ দুবছর আগেই ১৯০৮ খ্রিঃ কিশোর ক্ষুদিরাম এবং প্রফুল্ল চাকি বিহারের মুজঃফরপুরে বোমা ফাটিয়েছিলেন বিদেশী বিচারপতি অত্যাচারী কিংসফোর্ডকে হত্যার জন্য। সেই ঘটনার পর গোটা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল বিপ্লবের আগুন। বীর ক্ষুদিরাম – প্রফুল্লর সাহসিকতায় উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিলেন বসন্তকুমার। দেশমাতৃকার মুক্তির প্রেরণার তলায় তলিয়ে গিয়েছিল অভাবী সংসারের দুঃখমোচনের চিন্তা। তার দেশাত্মবোধ ক্ষুদ্র সংসারের গন্ডি অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র দেশের বৃত্তে।

দেশবাসীর মুক্তিই হয়ে উঠেছিল তাঁর স্বপ্ন ও সঙ্কল্প। গ্রামের বাড়িতে থাকার সময়েই তিনি গোপনে শিখে নিয়েছিলেন আগ্নেয়াস্ত্র চালনার কৌশল। তার এক সম্পর্কিত ভাই ছিলেন পুলিশের সাব – ইনসপেকটর। তিনি যখন বাড়িতে আসতেন তাঁর সঙ্গে থাকত ব্রিচ লোডার বন্দুকটি। কিশোর বসন্তকুমার সেই বন্দুক নিয়ে সকলের অগোচরে বেরিয়ে পড়তেন পাখি শিকার করতে। বিলের দিকে গিয়ে অনেক সময় তিনি কুমিরও শিকার করতেন। তারপর যথারীতি ফিরে এসে বন্দুকটি যথাস্থানে রেখে দিতেন। লক্ষ্যভেদ করার কাজে এভাবেই হাত তৈরি করে নিয়েছিলেন বসন্তকুমার।

আরও পড়ুন: ভি.আই. লেনিন জীবনী

আরও পড়ুন: বিপ্লবী বসন্ত কুমার বিশ্বাস জীবনী

আরও পড়ুন: মার্টিন লুথার কিং জীবনী

আরও পড়ুন: জওহরলাল নেহেরু জীবনী

আরও পড়ুন: মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক জীবনী

অমরেন্দ্রনাথের সঙ্গে যোগাযোগের পর কিশোর বসন্তকুমার চন্দননগর ও অন্যান্য স্থানে গিয়ে বোমা তৈরির কৌশলও রপ্ত করে ফেলেছিলেন। ১৯১০ খ্রিঃ রাসবিহারীর সংস্পর্শে আসার পর বসন্তকুমারের জীবনে বিরাট পরিবর্তনের সূচনা হল। দেরাদুনে একটি গোপন বিপ্লবী সংস্থা গড়ে তুলে সেখানেই সাময়িকভাবে অবস্থান করছিলেন রাসবিহারী। বসন্তকুমার উপস্থিত হলেন সেখানে। প্রথম আলাপেই মুগ্ধ হলেন রাসবিহারী।

দেশসেবায় আগ্রহী কিশোর বসন্তকুমারের মধ্যে আগামীকালের এক সম্ভাবনাময় বিপ্লবীকে প্রত্যক্ষ করলেন তিনি। নিষ্পাপ, নিরলস, সাহসী ও বুদ্ধিমান বিপ্লবী কর্মীই যে তিনি দেশময় সন্ধান করে বেড়াচ্ছেন। রাসবিহারী কাছে টেনে নিলেন বসন্তকুমারকে। প্রথম থেকেই তিনি আস্থাভাজন করে নিলেন তাকে। পাঁচ সদস্যের একটি গুপ্তচক্র গড়ে তুলেছিলেন রাসবিহারী। বসন্তকুমার সেই বিশেষ চক্রের অন্যতম সদস্য মনোনীত হলেন। তাঁর প্রশিক্ষণ চলল পুরোদমে। দেরাদুন হল উত্তর প্রদেশের একটি পাহাড়ি শহর। শহরের চারপাশে সে সময়ে ছিল প্রচুর আমবাগান।

রাসবিহারী বিপ্লবীদের প্রশিক্ষণ দেবার জন্য এমনি একটি আমবাগানই বেছে নিয়েছিলেন। সেখানেই বসন্তকুমারের তালিম শুরু হল। কিছু খুঁটি পরপর সেখানে পুঁতে দেওয়া হয়েছিল। সিগারেটের কৌটোয় মাটি ভর্তি করে বসন্তকুমারের হাতে দেওয়া হত। ওই কৌটো দূর থেকে খুঁটির দিকে তাক করে ছুঁড়তে হত। বসন্তকুমার টানা তিন মাস এভাবে লক্ষ্যভেদে নিজেকে প্রস্তুত করলেন। এই তালিম ছিল সঠিক লক্ষ্যে বোমা ছোঁড়ার দক্ষতা আয়ত্তে আনার কৌশল। গোপন আস্তানায় এই প্রশিক্ষণের লক্ষ্য যে কেবল আমবাগানের পোঁতা খুঁটিগুলি নয়, তা বসন্তকুমার ভালই বুঝতে পারতেন।

কিন্তু জানতেন না কোন বিশেষ কাজের জন্য তাঁকে এভাবে প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। ক্ষুদিরামের বোমা ছোঁড়ার ঘটনার কথা ততদিনে দেশের সকলেই জেনে গেছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই বসন্তকুমার বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁকেও হয়তো অবিলম্বে দেশমাতৃকাব মুক্তিসংগ্রামের কোন পবিত্র দায়িত্ব পালন করতে হবে। প্রশিক্ষণ শেষ হলে রাসবিহারী বসন্তকুমারকে সঙ্গে নিয়ে পাঞ্জাবের লাহোরে গেলেন ১৯১২ খ্রিঃ। এখানে আগেই তিনি গুপ্তসমিতি গঠন করেছিলেন। বাঙ্গালী তরুণ বসন্তকুমারকে পুলিশের সন্দেহের বাইরে রাখার জন্য তিনি স্থানীয় একটি ওষুধের দোকান পপুলার ফার্মেসিতে কম্পাউন্ডারের চাকরিতে ঢুকিয়ে দিলেন।

এখানে একটি ছদ্মনামও বসন্তকুমারকে দেওয়া হল – বিপিন দাস। লাহোরের আগরওয়ালা আশ্রম ছিল বিপ্লবীদের মিলিত হবার স্থান। ১৯১২ খ্রিঃ ১৩ অক্টোবর এখানে এক গোপন বৈঠকে উপস্থিত হলেন বসন্তকুমার। সেখানে উপস্থিত ছিলেন আরও তিন তরুণ বিপ্লবী। এঁরা হলেন, লাহোরের বালমুকুন্দজি এবং দিল্লির দীননাথ ও অবোধবিহারী। বিপ্লবী রাসবিহারী এই চার তরুণের কাছে তার পরিকল্পনার কথা জানালেন। ভারতের গভর্নর জেনারেল তখন লর্ড হার্ডিঞ্জ। তাঁরই উদ্যোগে কলকাতা থেকে দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তরিত করা হচ্ছে রাজনৈতিক কারণে।

তার প্রধান উদ্দেশ্য যে বিপ্লবীদের ওপরে বড় রকমের আঘাত হানা তা বুঝতে বাকি ছিল না রাসবিহারীর। যাই হোক, নতুন রাজধানীতে বড়লাটের অভিষেক উপলক্ষ্যে লর্ড হার্ডিঞ্জকে নিয়ে এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার আয়োজন হচ্ছে। সেই শোভাযাত্রায় বড়লাটের স্তাবক অনুচরেরা তাঁর অনুগমন করবে। রাসবিহারী জানালেন বসন্তকুমারের কাজ হবে নিজেদের তৈরি বোমার আগুনে বড়লাটকে বরণ করা। বসন্তকুমারের দেহমন যেন এমনি একটি কাজের জন্যই উন্মুখ হয়ে ছিল। আনন্দে উত্তেজনায় তিনি বারবার রোমাঞ্চিত হতে লাগলেন।

গত তিন মাস ধরে দেরাদুনের আমবাগানে যে লক্ষ্যভেদের প্রশিক্ষণ তার হয়েছে, এতদিনে তার উদ্দেশ্য তাঁর কাছে পরিষ্কার হল। রাসবিহারী বসন্তকুমারকে নিয়ে দিল্লি পৌঁছলেন ২৬ শে ডিসেম্বর। আস্তানা নিলেন অধ্যাপক আমিরচাদের বাড়িতে। বিপ্লবীদলের অন্যতম সংগঠক ছিলেন আমীর চাঁদ। দেশের বিপ্লবীদের উৎসাহ উদ্দীপনার বৃদ্ধি ও সাধারণ মানুষের মধ্যে জাগরণ ঘটাবার জন্যই যে ব্রিটিশ শাসনের ওপর মহলের প্রতিনিধিদের খতম করা দরকার এই পরামর্শ ছিল আমীর চাঁদেরই !

এখানে পৌঁছেই রাসবিহারী দিল্লি শহরের একটি মানচিত্র সংগ্রহ করলেন। নিজে আগে ভাল করে দেখে বুঝে নিলেন। পরে রাত গভীর হলে তিনি বসন্তকুমারকে সঙ্গে নিয়ে পথঘাট চেনাবার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। প্রথমে তারা উপস্থিত হলেন চাঁদনিচকে। সেখানে অদূরেই একটি ঝুলবারান্দাওয়ালা বাড়ি। সেদিকে দেখিয়ে রাসবিহারী বসন্তকুমারকে জানালেন, ওই বারান্দায় বড়লাটের শোভাযাত্রা দেখবার জন্য প্রীতমদাসজির বাড়ির মেয়েরা থাকবেন।

বসন্তকুমারকে নারীর ছদ্মবেশে ওখানে মেয়েদের মধ্যে অপেক্ষা করতে হবে। বড়লাট হার্ডিঞ্জকে নিয়ে রাজকীয় শোভাযাত্রা বের হল ১৯১২ খ্রিঃ ১৩ ই ডিসেম্বর। সেদিনের অসম্ভব ঠান্ডা উপেক্ষা করেও হাজার হাজার মানুষ চাঁদনিচক থেকে রাজপথের দুধারে সার দিয়ে ভিড় করেছে। আগ্রহ কৌতূহলে আনন্দিত হচ্ছে জনসমুদ্র। হাতির পিঠে রুপোর হাওদায় মণিমুক্তা খচিত সিংহাসনে বসে আছেন ব্রিটিশ ভারতের বড়লাট। তার সামনে পেছনে বিশাল শোভাযাত্রা।

ব্যান্ডে বাজছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের জাতীয় সংগীত গড় সেভ দ্য কিং – এর সুর। রিবদ্ধ অশ্বারোহী সেনাবাহিনী চলেছে পেছন পেছন। তাদের প্রত্যেকের হাতে উন্মুক্ত কৃপাণ। শোভাযাত্রার সামনে পেছনে হাওয়ায় আন্দোলিত হচ্ছে অজস্র ইউনিয়ন জ্যাক। পরিকল্পনা নির্ধারিত ছিল। জনৈকা লীলাবতীর পরিচয় দিয়ে বসন্তকুমার মহিলার বেশে নিজেকে ঢেকে প্রীতমদাসজির বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে মিশে ছিলেন। পথের উল্টো দিকের ভিড়ের মধ্যে ছিলেন বিপ্লবী রাসবিহারী।

আরও পড়ুন: গণেশ ঘোষ জীবনী

আরও পড়ুন: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবনী

আরও পড়ুন: জোসেফ স্তালিন জীবনী

আরও পড়ুন: মাও সেতুং জীবনী

আরও পড়ুন: বারীন্দ্রকুমার ঘোষ জীবনী

একসময় তার ইঙ্গিত পেয়ে বসন্তকুমার মহিলার বেশ পরিত্যাগ করে সাধারণ বেশে গিয়ে দাঁড়ালেন পাশে। কিছুটা দূরেই ভিড়ের মধ্যে মিশে আছেন আর এক বিপ্লবী যুবক দিল্লির অবোধবিহারী। তাঁর হাতেও লুকনো রয়েছে বোমা। শোভাযাত্রা এগিয়ে চলেছে রাজপথ ধরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই লর্ড হার্ডিঞ্জের রাজকীয় হাতি কাছাকাছি এগিয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে নির্ভুল লক্ষ্যে বসন্তকুমার ছুঁড়ে দিলেন হাতের বোমা। বিস্ফোরণের বিকট শব্দে কেঁপে উঠল চারদিক। লর্ড হার্ডিঞ্জের রক্তাক্ত দেহ লুটিয়ে পড়ল হাতির পিঠের হাওদা থেকে। সঠিক লক্ষ্যে নির্ভুল লক্ষ্যভেদ করেছেন বসন্তকুমার। মুহূর্তের মধ্যে রাজকীয় শোভাযাত্রা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল।

হার্ডিঞ্জ সাহেবকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। দেখা গেল সাংঘাতিকভাবে আহত তিনি, তবে জীবনহানির আশঙ্কা নেই। ওদিকে নির্ভুলভাবে নিজের দায়িত্ব পালন করে উধাও হয়েছেন বসন্তকুমার। পুলিশ বা সেনাবাহিনীর শ্যেনদৃষ্টি তার কোন হদিশই পেল না। দেরাদুন পৌঁছে দিন কয়েক আত্মগোপন করে রইলেন। পরে সেখান থেকে চলে গেলেন লাহোরে। আবার সেই ওষুধের দোকানে। বিপিন দাস সেই দোকানের এক সাধারণ কর্মচারী।

বড়লাট বেঁচে গেলেও আতঙ্কে কেঁপে উঠল ব্রিটিশ শাসকমহল। ইংলন্ডেও এই সংবাদ আলোড়ন তুলল। ভারতে ব্রিটিশ শাসন – শোষণের প্রতিবাদ যে ক্রমশঃ সোচ্চার হতে শুরু করেছে তা ভালভাবেই বুঝতে পারল ব্রিটিশ প্রশাসন। সাধারণ কোন রাজকর্মচারী নয় খোদ বড়লাটকেই হত্যার চেষ্টায় এগিয়ে এসেছে পদানত ভারতবাসী। বড়লাট হত্যার ষড়যন্ত্র তদন্ত করবার জন্য প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। খোদ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে এসে হাজির হল বিখ্যাত গোয়েন্দার দল।

দিল্লি ষড়যন্ত্র মামলা নাম দিয়ে একটা মামলাও শুরু হল লর্ড হার্ডিঞ্জের ওপর আক্রমণের ঘটনাকে নিয়ে। বসন্তকুমার লাহোরেই রয়েছেন। ইতিমধ্যে রাসবিহারীর কাছে খবর এল, উত্তরবঙ্গের পাবনার দয়ানন্দ আশ্রমে ইংরাজ জেলাশাসক লর্ড গর্ডন ক্যাপ্টেন মহেন্দ্ৰ দত্তকে গুলি করে হত্যা করেছে। জেলাশাসকের সন্দেহ হয়েছিল, ওই আশ্রমের সঙ্গে বিপ্লবীদের সংযোগ রয়েছে। বিপ্লবীরা এবারে জেলাশাসক লর্ড গর্ডনকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন। ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে কর্তৃপক্ষ গর্ডনকে সুদূর লাহোরে বদলি করে নিরাপদ দূরত্বে পাঠিয়ে দেয়।

এইসব খবর পেয়ে রাসবিহারী লাহোরের বিপ্লবীদের নিয়ে গোপনে বৈঠক করলেন। স্থির হল, এখানেই অত্যাচারী গর্ডনকে হত্যা করে প্রতিশোধ নিতে হবে। এই গুরুদায়িত্বও হাসিমুখে গ্রহণ করলেন বসন্তকুমার। খবরাখবর সংগ্রহ শুরু হল। জানা গেল লাহোরের এক নৈশ ক্লাবে লর্ড গর্ডন সহ বহু ইংরাজ প্রতি সন্ধ্যায় জড়ো হয়। আনন্দফুর্তি আর সুরাপান করে। বসন্তকুমার সেই ক্লাবে আক্রমণ চালিয়ে গর্ডনকে হত্যার জন্য প্রস্তুত হলেন।

একবছর আগেই ১৯১২ খ্রিঃ ডিসেম্বরে দিল্লিতে লর্ড হার্ডিঞ্জকে হত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় ক্ষোভ জমা হয়েছিল মনে। এবারে যাতে ব্যর্থ হতে না হয় তার জন্য নিজেকে সেভাবেই প্রস্তুত করে নিলেন তিনি। ১৯১৩ খ্রিঃ ১৭ ডিসেম্বর। এইদিন বসন্তকুমার নৈশক্লাবে যাওয়ার পথে একটি মারাত্মক বিস্ফোরক বোমা পেতে রাখলেন। কিছু সময় পরেই লর্ড গর্ডন সেই পথে যাবেন। কিন্তু ঘটনাচক্রে প্রথম উদ্যোগই ব্যর্থ হয়ে গেল। লর্ড গর্ডনের আসার আগেই এক চাপরাশি আচমকা সাইকেল চেপে ওই পথ দিয়ে যাবার সময় বোমা বিস্ফোরিত হয়ে গেল। চাপরাশিটি ঘটনাস্থলেই মারা গেল।

একবছরের মধ্যে দু’দুটো আক্রমণের ঘটনা ঘটে গেল। বিদেশী শাসকরা রীতিমত আতঙ্কিত হয়ে উঠল। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডেব গোয়েন্দারা দিল্লির বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা নিয়ে তদন্ত শুরু করেছিল। এবারে তাদের কাজের সঙ্গে যুক্ত হল লাহোর। নানান নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা – নিরীক্ষার পর ঝানু গোয়েন্দারা বুঝতে পারলেন, দুটি বোমাই একই রকম মালমশলা দিয়ে তৈরি, দুটি ঘটনার সঙ্গে একই দল জড়িত। সেই সময়ে বোমা তৈরির কাজে বাংলার বিপ্লবীদের দক্ষতার কথ সুবিদিত ছিল।

সেই সূত্র ধরে ব্রিটিশ প্রশাসন বাংলায় ব্যাপক তল্লাশি শুরু করল। সেই সঙ্গে বড়লাট ও গর্ডন হত্যার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িতদের ধরবার জন্য মোটা অঙ্কের পুরস্কার ঘোষণা করল। দিল্লি – লাহোর দুর্ঘটনার যোগসূত্র আবিষ্কার হতে দেরি হল না। গোয়েন্দারা জেনে গেল, এই গোপন ষড়যন্ত্রের নায়ক হলেন রাসবিহারী বসু। তাঁর ভাবশিষ্য বসন্তকুমারের নামও তারা উদ্ধার করল ! পুলিশের গতিবিধি বুঝতে পেরে বিপ্লবীরা ছদ্মবেশে আত্মগোপন করলেন।

বসন্তকুমার লাহোর ছেড়ে এসে বাংলার গ্রামে আশ্রয় নিলেন। রাসবিহারী নবদ্বীপে আত্মগোপন করলেন। ১৯১৪ খ্রিঃ বসন্তকুমারের গ্রামের বাড়িতে তাঁর বাবা মারা গেলেন। খবর পেয়ে তিনি গোপনে পোড়াগাছা গ্রামে উপস্থিত হলেন। বাবার শেষ কাজ সম্পন্ন করবার জন্য স্বাভাবিক ভাবেই উতলা হয়ে পড়েছিলেন তিনি। একদিন শ্রাদ্ধের জিনিসপত্র কেনার জন্য কৃষ্ণনগরে গেলেন। সেখানে যে আত্মীয়ের বাড়িতে তিনি উঠেছিলেন, সেখানেই শেষ পর্যন্ত এক আত্মীয়ের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন বসন্তকুমার।

সময়টা ১৯১৪ খ্রিঃ ২৬ শে ফেব্রুয়ারি। প্রায় একই সময়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল আমিরচাদ, অবোধবিহারী বালমুকুন্দ প্রমুখ বিপ্লবীদের। এঁদের সকলকে দিল্লীর ম্যজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হল ১৬ ই মার্চ। রাজদ্রোহ, ষড়যন্ত্র এবং বিস্ফোরক দ্রব্য রাখার অভিযোগ সকলের বিরুদ্ধে আনা হল। বিচারের প্রহসন হল ২১ শে মে দিল্লীর দায়রা আদালতে। এই বিচারে বিপ্লবীদের হয়ে সওয়াল করলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ।

আরও পড়ুন: জুসেপ্পে গারিবালদি জীবনী

আরও পড়ুন: লিওন ট্রটস্কি জীবনী

আরও পড়ুন: ভিকাজী রুস্তম কামা জীবনী

আরও পড়ুন: বাল গঙ্গাধর তিলক জীবনী

আরও পড়ুন: বিপিনচন্দ্র পাল জীবনী

আরও পড়ুন: রানী প্রথম এলিজাবেথ জীবনী

দিল্লীর বিচারে ফাঁসির হুকুম হল অবোধ বিহারী, বালমুকুন্দ এবং আমিরচাদের। বয়স কম বলে কিশোর বসন্তকুমারের বারো বছরের কারাদন্ড হল। বসন্তকুমারকে ফাসির দড়িতে ঝুলানোই ছিল ইংরাজ শাসকের উদ্দেশ্য। প্রথম প্রচেষ্টা ফসকে গেলেও তারা নিরস্ত হল না। লন্ডন থেকে দুজন আইন বিশেষজ্ঞ আনা হল। তাদের পরামর্শে লাহোর হাইকোর্টে ইংরাজ সরকারের পক্ষে আপিল করা হল।

বসন্ত কুমার বিশ্বাস এর মৃত্যু: Basanta Kumar Biswas’s Death

একরকম একতরফা ভাবেই লাহোর হাইকোর্ট ১৯১৫ খ্রিঃ ১০ ফেব্রুয়ারী রায় প্রকাশ করল— “Basanta Kumar Biswas will be hunged until death …” ফাঁসির দিন নির্দিষ্ট হল ১১ ই মে। বসন্তকুমারকে রাখা হল লাহোর জেলে। এইসময় তার দাদা কামাখ্যচরণ তার সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। নির্ভীক নির্বিকার কিশোর বিপ্লবী তাঁর দাদাকে বলেছিলেন যে, মা যেন দুঃখ না করেন। বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ এবং অত্যাচারী লর্ড গর্ডনকে হত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েচেন।

মৃত্যুর পূর্বে এটাই তার একমাত্র মর্মপীড়া। তবে “ অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে আমি আবার ফিরে আসব। ” ১৯০৮ খ্রিঃ একই সংকল্প ঘোষিত হয়েছিল মৃত্যুপথযাত্রী অপর এক বিপ্লবী কিশোরের কণ্ঠে। তিনি হলেন শহীদ ক্ষুদিরাম। নির্দিষ্ট দিনে, ১৯১৫ খ্রিঃ ১১ মে তারিখে পাঞ্জাবের আম্বালা জেলে নিশীথ রাতে হাসিমুখে বসন্তকুমার ফাসির দড়ি গলায় তুলে নিলেন। সেই সময়ে বয়স তার একুশ বছরও পূর্ণ হয়নি। মৃত্যুর আগে তিনি আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে ধ্বনি তোলেন – বন্দেমাতরম ! বন্দেমাতরম !

Leave a Reply